ঈমানদীপ্ত গল্পের আসর, গল্প - ০৬: গুপ্তহত্যা করতে এসে ইসলাম গ্রহণ - ছুমামা ইবনে উছাল (রা) Powerful Reminder - 06

ঈমানদীপ্ত গল্প - ০৬

ছুমামা ইবনে উসাল (রা) এর ইসলাম গ্রহণ

গুপ্তহত্যা করতে এসে ইসলাম গ্রহণ - ছুমামা ইবনে উছাল (রা),  ঈমানদীপ্ত গল্প, ইসলামি গল্প, হাদিসের গল্প, সাহাবীদের গল্প,  শিক্ষণীয় গল্প, ছোটদের গল্প, বড়দের গল্প, ইতিহাসের গল্প, ঈমানী কথা


    ষষ্ঠ হিজরীতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহির্বিশ্বে ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের কাজে মনােনিবেশ করেন। এ লক্ষ্যে তিনি সমকালীন আরব ও অনারব বিশ্বের মােট আটটি দেশের রাজা-বাদশাহ’র কাছে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে দূত মারফত চিঠি প্রেরণ করেন। এই আটজন রাজা-বাদশাহর মধ্যে ছুমামা ইবনে উছাল আল হানাফী অন্যতম। সে একাধারে বনূ হুনাইফা গোত্রের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা এবং ইয়ামামা নামক রাষ্ট্রের অত্যন্ত পরাক্রমশালী ও স্বৈরাচারী বাদশাহ। এ রাজ্যে তার হুকুম অমান্য করার সাধ্য কারাে ছিল না । রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ দূত-মারফত প্রেরিত চিঠিকে ইয়ামামার বাদশাহ ছুমামা ইবনে উছাল অত্যন্ত তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করে। সে আল্লাহর দাসত্ব এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের মাধ্যমে ইহকালীন শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তি ও কল্যাণের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে গর্ব ও অহঙ্কারে মেতে উঠে বলে :

‘আমার মতাে প্রভাবশালী ইয়ামামার বাদশাহকে আনুগত্যের আহ্বান জানিয়ে মুহাম্মদ নিরাপদে বসবাস করবে? এ কী করে সম্ভব?

রাগে, ক্ষোভে ও অহমিকায় প্রায় উন্মাদ হয়ে সে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র আঁটতে শুরু করে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর দাওয়াতকে দুনিয়া থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলেই তার আত্মমর্যাদা রক্ষা পাবে- এটাই ছিল তখন তার একমাত্র অভিপ্রায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিদ্রিতাবস্থায় অথবা অন্য কোনাে অসতর্ক মুহূর্তে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ইয়ামামার বাদশাহ ছুমামা ইবনে উছাল মদীনায় গিয়ে পৌঁছল। চোরাগুপ্তা হামলার মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করার জন্যে সে ওৎ পেতে থাকে। এমনিভাবে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক অসতর্ক মুহুর্তে ছুমামা প্রায় তাকে হত্যাই করে ফেলত, যদি তার চাচা তাকে এর ঠিক পূর্বমুহূর্তে এ কাজ থেকে বিরত না করত।

রাসূলুল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করা থেকে বিরত হলেও তার হামলা থেকে কয়েকজন সাহাবী রক্ষা পেলেন না। ব্যর্থতার গ্লানিকে মুছে ফেলার জন্য রাতের আঁধারে সাহাবীদের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে ছুমামা ইবনে উছাল ইয়ামামায় পালিয়ে গেল। সাহাবায়ে কেরামের উপর এই নির্মম ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। এভাবে চোরাগুপ্তা হামলার মাধ্যমে হত্যা করার দুঃসাহস যেন আর কেউ করতে না পারে সে জন্যে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুমামা ইবনে উছালকে হত্যার মাধ্যমে এর প্রতিশােধ নেওয়ার জন্যে সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন।

এ ঘটনার কিছুদিন পর ইয়ামামার সেই বাদশাহ ছুমামা ইবনে উছাল ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সদলবলে মক্কার পথে রওয়ানা হলাে। তার উদ্দেশ্য ছিল, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের হত্যার সাফল্যে আনন্দিত হয়ে সে খানায়ে কাবা তাওয়াফ করবে এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দেবতাদের সম্মানার্থে পশু বলি দেবে। চোরাগুপ্তা হামলা ও নবপ্রতিষ্ঠিত ক্ষুদে ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর শত্রু পক্ষের সম্ভাব্য আকস্মিক হামলা প্রতিরােধ করার জন্যে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যথাযথ পাহারার ব্যবস্থা করলেন। সশস্ত্র ছােট ছােট গ্রুপের মাধ্যমে শত্রুদের গতিবিধির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখার জন্য ঐসব স্থানে নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা করা হলাে।

এদিকে ইয়ামামার সেই বাদশাহ ছুমামা ইবনে উছাল তার দলবল নিয়ে ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে বিকল্প পথ না থাকায় অত্যন্ত সঙ্গোপনে মদীনার নিকটবর্তী ঐ একমাত্র পথ ধরে রাতের আঁধারে মক্কার দিকে যাচ্ছিল; কিন্তু মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের টহলরত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে পথ অতিক্রম করা তাদের পক্ষে সম্ভব হলাে না। টহলরত বাহিনীর চোখে ধুলা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রয়াসকালে ছুমামা ইবনে উছাল নিজেই মুসলমানদের হাতে ধরা পড়ে গেল।

মুসলিম সৈনিকরা ছুমামা ইবনে উছালকে শত্রুপক্ষের একজন সাধারণ সৈন্য মনে করে মদীনায় নিয়ে এসে মসজিদে নববীর একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে। সন্দেহভাজন এই দুষ্কৃতকারীর বিচারের ব্যাপারে সাহাবীগণ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলেন। এদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাষ্ট্রীয় কাজে মসজিদে নববীতে প্রবেশের সময় ইয়ামামার সেই বাদশাহ ছুমামা ইবনে উছালকে খুঁটির সাথে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেলেন।

তিনি সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বললেন :

‘তােমরা কি জানাে, কাকে এই খুঁটির সাথে বেঁধে রেখেছ? উত্তরে সাহাবীগণ বললেন : না, আমরা তাে তাকে চিনি না।' রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : এই সেই ইয়ামামার অহংকারী বাদশাহ ছুমামা ইবনে উছাল আল হানাফী। তােমরা এই বন্দীর সাথে অত্যন্ত উত্তম ব্যবহার করবে।' অতঃপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রয়ােজনীয় কার্য সম্পাদন শেষে বাসায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের বললেন :

اجمعوا ما كان عندكم من طعام وابعثوا به إلى ثمامة بن أثال ....

‘তােমাদের কাছে খাবার কী আছে? সত্বর নিয়ে এসাে এবং ছুমামা ইবনে উছালের জন্যে পাঠিয়ে দাও।' এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন :

‘আমার উটনীকে সকাল-বিকাল দোহন করে যেন সে দুধ চুমামার জন্যে নিয়মিত পাঠানাে হয়। রাসূলুল্লাহ (স) ছুমামাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য হাজির করার পূর্ব পর্যন্ত তার সাথে সর্বপ্রকার উত্তম ব্যবহার অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করলেন।


রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুমামার অতীত কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ডের জন্যে তাকে কোনােরূপ তিরস্কার না করে ইসলামের সুমহান দাওয়াত তার কাছে পেশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ছুমামার কাছে গিয়ে বললেন :

ছুমামা! তােমার কি কিছু বলার আছে ? ছুমামা ইবনে উছাল আরয করল :

‘আপনি যদি আমার উপর থেকে আপনার সাহাবীদের রক্তের প্রতিশােধ নিতে চান, তাহলে আমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন এবং তা আপনার জন্য অতিরঞ্জিত হবে না...। আর যদি আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দেন, তাহলে আপনি আপনার একজন কৃতজ্ঞ ব্যক্তিকেই ক্ষমা করবেন। যদি অর্থের বিনিময়ে আমাকে ক্ষমা করতে চান, তাহলে আপনি যে পরিমাণ অর্থের দাবি করবেন, আমি তা দিতে ব্যধ্য থাকবাে।


প্রথম দিন এই সামান্য কথা বিনিময়ের পর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু'দিন পর্যন্ত আর চুমামার সাথে কোনাে কথা বললেন না। অপরদিকে, তিনি তার পানাহার ও আরাম-আয়েশের জন্যে পূর্বের চেয়ে আরও উত্তম ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। প্রতিদিনই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটনী দোহন করে তার কাছে যথারীতি দুধ সরবরাহ করা হচ্ছিল। তৃতীয় দিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুমামা ইবনে উছালকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন :

‘ছুমামা! তােমার কি কিছু বলার আছে ? ছুমামা বললাে :

না, বলার আর কিছু নেই। যা আরয করার তা আপনাকে পূর্বেই করেছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা করেন, তাহলে এক কৃতজ্ঞকেই ক্ষমা করবেন। আর যদি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন, তাহলে তা আমার উপযুক্ত পাওনাই পরিশােধ করা হবে। আর যদি অর্থের বিনিময়ে আমাকে ক্ষমা করতে চান,

তাহলে বলুন, যত অর্থের প্রয়ােজন তা আমি দিতে প্রস্তুত।' তার এ উত্তর শুনে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে পরবর্তী দিনের জন্যে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরের দিন তিনি তাকে 


পূর্বের মতাে একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। দুমামা পূর্বের ন্যায় আরয করল :

যদি আমাকে ক্ষমা করেন, তাহলে এক কৃতজ্ঞকেই ক্ষমা করবেন। আর যদি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন, তাহলে তা হবে আমার কৃত অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি। আর যদি অর্থের বিনিময়ে আমাকে ক্ষমা করতে চান, তাহলে বলুন,

কত অর্থের প্রয়ােজন, আমি তা পরিশােধ করতে প্রস্তুত। ছুমামার এই একই ধরনের উত্তর শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বললেন :

‘তােমরা ছুমামাকে মুক্ত করে দাও।' রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পাওয়ামাত্র ছুমামাকে ছেড়ে দিয়ে তাকে মুক্ত হিসেবে ঘােষণা করা হলাে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে ক্ষমা পেয়ে ছুমামা ইবনে উছাল সােজা মসজিদে নববীর সন্নিকটে বাকী নামক স্থানে গােসল করতে চলে গেল। সেখানে সে অতি উত্তমভাবে গােসল সেরে পাক-পবিত্র হয়ে পুনরায় মসজিদে নববীতে ফিরে এসে উপস্থিত সাহাবীদের বৈঠকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘােষণা করল :

أشهد أن لا اله الا الله، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله.

‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনাে ইলাহ নেই এবং আমি এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দাহ ও প্রেরিত রাসূল।' কিছুক্ষণ পূর্বেও যে ছুমামা ইবনে উছাল ছিলেন ইসলামের চরম দুশমন, উদ্ধত ও অহংকারী পৌত্তলিক- পরশ পাথররূপী রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিন দিনের সাহচর্য, সান্নিধ্য, ক্ষমা ও ভালােবাসায় অবিভূত হয়ে পবিত্র কালেমায়ে শাহাদাতের ঘােষণার মাধ্যমে সেই ছুমামা ইবনে উছালই পরিণত হলেন পূর্ণ মুসলিম এবং ইসলামের আপসহীন সৈনিকে।






Post a Comment

0 Comments