বনের রাজা শিয়াল কেন?

 

বনের রাজা শিয়াল কেন?

সিংহ আর শিয়ালের গল্প




বনের রাজা শিয়াল কেন?

একটা সময় বিশ্বের সকল বনেই রাজত্ব করত প্রকৃত সিংহরা।  কিন্তু সময়ের আবর্তনে সিংহরা নিজেদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন শিয়াল, হায়েনা এরাই সকল বনগুলোতে রাজত্ব এটে নিয়েছে।

সিংহদের এরকম পরিণতির কারণ তারা নিজেই। যখন তাদের পূর্বগোষ্ঠীরা বন গুলো জয় করেছিল, তখন তাদের পূর্বগোষ্ঠীরা ছিলো কর্মঠ। তারা নিজেদের কে বিলাসিতায় ডুবিয়ে রাখত না। তারা জানত শিকারের কলাকৌশল এবং শত্রুদের দূর্বলতা। 

সিংহদের শিকারের কৌশল ছিল সুন্দর। আর তারা বনের অন্য কিছুকে ভয় পেত না।  বরং অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার গুলোই তাদের ভয় করত। তারা সবসময় নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে রাখতো। নিজেদের শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধি করতো যাতে কেউ তাদের বিরুদ্ধে দাড়াতে না পারে। 

সিংহদের আরেকটি বিষয় ছিল চমৎকার। তারা ছিল ঐক্যবদ্ধ। এরা দলবদ্ধভাবে শত্রুকে আক্রমণ করতো, তাদের শিকার ধরতো। যাতে শিকার ধরতে গিয়ে হারতে না হয় এবং কেউ বিপদে পড়লেও তাকে সাহায্য করা যায়। তারা নিজেদের মধ্যে তৈরি করেছিলো আন্তরিক ভালোবাসা আর সহোযোগিতা। তাই তাদের একজন শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে অপরজন তার সাহায্যের জন্য ঝাপিয়ে পড়ত। এ যেন এক দেহ। যেখানে এক অঙ্গ ব্যথা হলে সারা শরীরের মধ্যেই খারাপ বোধ হয়। আর তাই অতি দ্রুত সেই অঙ্গকে সুস্থ করতে সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হয়।

সিংহরা শুধু শক্তিশালী ছিল তাই কিন্তু নয়। বুদ্ধিতেও তারা ছিল চতুর। তারা নিজেদের  সুস্বাস্থ্য ও শক্তি বজায় রাখার কৌশল রপ্ত করত। নতুন নতুন শিকারের পদ্ধতি এবং আবাসস্থল সুন্দর রাখার পদ্ধতিগুলো আয়ত্ত্ব করত। মোটকথা, সবদিকেই তারা নজর রাখত। আর নিজেদের রাজত্ব, শক্তি টিকিয়ে রাখতে সব বিষয়ে পারদর্শী হওয়াও তো প্রয়োজন। 

সিংহরা তাদের পরবর্তী বাচ্চা সিংহদের তা শিখিয়ে রাখত যাতে সময়ের স্রোতে দক্ষতাগুলো হারিয়ে না যায়। আর তারা বেশি বেশি সিংহশাবক নেওয়ার চেষ্টা করতো নিজেদের সিংহদলকে শক্তিশালী করার জন্য। কারণ, সিংহ যদি বেশি হয় তবে তাদের শত্রু, শিকার সবাইকে ঘায়েল করা সহজ হবে। আর কথায়ও আছে, "দশের লাঠি একের বোঝা"।

সিংহরা শুধু শিকারই করত তা কিন্তু নয়। বিনা কারণে, বিনা প্রয়োজনে তারা কারো উপরই আক্রমণ করতো না। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করতো না। অকারণে কোন জন্তু-জানোয়ারকে জ্বালাতন করতো না।
আর কেউ কারো মাংস কিংবা শিকার চুরি করে খাওয়া, জোর করে কেড়ে নেয়া এসব থেকে তারা বিরত থাকত।

সিংহরা আরও একটি কাজ কারতো। তারা নিজেদের শক্তি, ক্ষমতা সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা করতো। যাতে শত্রুরা তাদেরকে ভয় করে। আবার তারা নিজেদের গুনাবলী, বৈশিষ্ট্য  প্রচার করত। যাতে অন্যান্য সিংহশাবকরা জানতে পারে নিজেদের সম্পর্কে, আসলে সিংহরা কেমন হয়? এভাবে প্রচার করে তারা অন্যান্য সিংহশাবকদের সতর্ক করতো, যাতে সিংহশাবক গুলো নিজেদেরকে প্রকৃত সিংহের ন্যায় গড়ে তুলতে পারে এবং দূর্বল না হয়।

কিন্তু যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের সকল ক্ষমতা, রাজত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তারা যখন থেকে নিজেদের বৈশিষ্ট্য ভুলে গেলো, নিজের খোরাক জোগানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো তখন থেকে একে একে তাদের রাজত্ব গুলো হারিয়ে যেতে লাগলো। 

যারা বনগুলো জয় করেছিলো তাদের পরবর্তীরা ছিলো খুবই অলস। তারা শিকারে যাওয়া বন্ধ করে দিলো শুধু তাদের কাছে খাবার আছে বলে। অন্য সিংহের খাবার আছে কিনা তা দেখার প্রয়োজন মনে করলো না।  

নিজেদের মধ্যকার যে নিয়ম-শৃংখোলা ছিলো তা তারা ভুলে গেলো। তারা এখন চিন্তা করলো কষ্ট করে খাবো কেন? আমরা যেহেতু বনের রাজা, তাই বিনা কষ্টেই আমরা খাবার সংগ্রহ করবো। তাই তারা অন্যের শিকার ছিনিয়ে নিতে লাগলো। এভাবে তারা পরিণত হলো চরম অলসে।

সিংহরা ভুলে যেতে লাগলো শিকারের কলাকৌশল।  ফলে বনের অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের মনে ধীরে ধীরে সিংহদের ভয় করা কমতে থাকলো। এমনকি সিংহদের খাবার-দাবারেও কিছু কিছু শিয়াল-হায়েনা ভাগ বসাতে লাগলো।

দীর্ঘদিন এভাবে চলতে চলতে শিয়ালের মনে বনের রাজত্ব পাওয়ার আশা জেগে উঠলো।  তাই সে ফন্দি আটতে লাগলো। সে সিংহকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা, আরাম-আয়েশের কথা বললো। সে বলতে লাগলো, আপনি বনের রাজা হওয়া সত্ত্বেও কেন এত ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন? 

আপনার কাজ তো হওয়া উচিত শুধু নিজের দিকে খেয়াল রাখা। বনের কোথায় কি ঘটলো না ঘটলো এত সব বিষয়ে মাথা ঘাটালে তো আপনি দূর্বল হয়ে যাবেন। আপনার শাবকদেরও তো সময় দেয়া উচিত, তাই না?

সিংহ বললো, কিন্তু অন্যের অবস্থাও তো জানা উচিত। আর আমার শিকারের ব্যবস্থাটাই বা হবে কি করে?
এবার শিয়াল বললো, যাবতীয় খবরাখবর না হয় আমরাই এনে দেবো। আর আপনার শিকার এবং খাবারের ব্যবস্থাও আমরাই করবো। আমরা কি আপনার বন্ধু নই?
আপনার চিন্তা করার কোন দরকার নেই।

যেহেতু খবরাখবর এর দায়িত্ব শিয়াল নিয়ে নিয়েছে, তাই সে এবার শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে গেলো। সিংহদের অন্যতম শক্তি ছিলো তারা দলবদ্ধভাবে কাজ করতো। তাই শিয়াল এবার বিভেদ সৃষ্টির পরিকল্পনা করলো। সে তার রাজা সিংহকে বললো, "আপনার শিকার অপর একটি সিংহ কেড়ে নিয়েছে"। সিংহ বললো, হয়ত তার বোঝায় ভুল হয়েছে তাই সে আমার শিকার নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু শিয়াল মিথ্যা বানিয়ে বললো, না সে ইচ্ছা করে জেনে বুঝেই নিয়েছে। সিংহ বললো, না, এটা হতে পারে না। সিংহরা আরেক জনের খাবার চুরি করে খায় না। সিংহের রেগে যাওয়া তে শিয়াল চুপটি করে সরে গেলো।

শিয়াল এবার চিন্তায় পরে গেলো, কিভাবে দোষ চাপানো যায়? শত্রুতা তৈরি করা যায়? সে তো নিজে শিকার করতে পারে না, অপরের শিকারে ভাগ বসানো কিংবা চুরি করা ছাড়া তো তার খাবার জোটে না। সে এবার হায়না কে তার বন্ধু বানালো। হায়নাও তো অপরের খাবার চুরি করে খায়। কথায় আছে না, " চোরে চোরে মাসতুতো ভাই"।

কিন্তু হায়েনারা শিকার করতে পারে। একাকী নয়, বরং দলবদ্ধভাবে। এবার হায়েনা আর শিয়াল উভয়ে মিলে অন্য সিংহের খাবার চুরি করতো এবং তাদের রাজা সিংহকে খেতে দিতো। আবার তাদের রাজা সিংহ কোন শিকার করলে নিজেরাই চুরি করে অন্য সিংহদের উপর চাপিয়ে দিতো। এভাবে সিংহদের মাঝে শত্রুতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারপরও সিংহরা নিজেদের মধ্যকার সন্দেহ মীমাংসা করতো না। তারা শিয়ালদের তথ্যেই বিশ্বাস করতো। আর এ কারণেই তাদের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হলো। 

সিংহরা আর অন্য সিংহদের সাহায্যে এগিয়ে আসলো না। কারণ, এখন শিয়াল তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। আর বিনাশ্রমে খাবার পেয়েই তারা খুশি। অন্যরা কি করলো না করলো তা দেখার সময় তার নেই। আর তথ্য সংগ্রহের দায়িত্বে যেহেতু শিয়ালরা, তাই সিংহদের কাছে এমনভাবে তথ্য আসতো যে তারা ভাবতো কারো কোন অসুবিধাই হচ্ছে না। দূর্বল সিংহদের ব্যাপারে শিয়াল জানাতো যে, তারা ভালোই আছে।  আর যেসব সিংহ একটু শক্তিশালী তাদের ব্যাপারে বলতো, সিংহরা  আপনার খাবার চুরি করে খাচ্ছে।

এভাবে দিন চলতে লাগলো। এবার শিয়াল সকল বনে জানিয়ে দিলো,  আমাদের রাজা খুবই সুখে আছে। তিনিই এখন সত্যিকারের রাজা কারণ এখন তিনি স্বাধীন। এখন অযথা মাথা ঘামানোর সময় তার নেই। আরাম-আয়েশ,  বিশ্রাম ও আনন্দে তার দিন কাটে। এসব শুনে অলস সিংহরা বললো, কিভাবে এটা হলো? শিয়াল বললো, তার সকল দায়িত্ব এখন আমার? তাকে আর কষ্ট করতে হয় না। তিনি তো রাজা তাকে কি কষ্টে রাখা যায়? তোমরা যদি এরকম সুখ পেতে চাও তবে ঝামেলা মুক্ত হয়ে অন্য পশুদের দায়িত্ব দাও। 

দেখা গেলো অন্য সিংহরাও ভাবতে লাগলো কাকে দায়িত্ব দেয়া যায়? তারা ভেবে দেখলো,  যেহেতু শিয়ালই চালাক বেশি এবং তার দ্বারা এক সিংহ বিলাসিতায় আছে,  তাই তাকেই দায়িত্ব দেয়া যায়। আবার কোন কোন সিংহ ভাবলো, হায়েনা শিকার করতে সক্ষম, তাকে দায়িত্ব দিলে আমাদের আর কষ্ট করে শিকার করতে হবে না। 

সিংহরা নিজেদের অলসতা আর বিলাসিতায় ধ্বংস হতে লাগলো। আর শিয়াল, হায়েনারা শক্তিশালী হতে লাগলো। 

ক্ষমতার আসনে সিংহকে দেখা গেলেও তারা বিড়ালের চেয়েও ভীতু হয়ে গেলো। সিংহের ক্ষমতায় থাকা না থাকাও শিয়ালরাই নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলো। তবুও সিংহদের হুঁশ ফিরলো না। ক্ষমতার আসন শিয়ালরাই দখল করতে থাকলো।

এভাবে বিশ্বের বনে বনে শিয়াল আর হায়েনার রাজত্ব কায়েম হতে লাগলো।






Post a Comment

0 Comments