ঈমানদীপ্ত গল্পের আসর, গল্প - ০৫ (ইয়ামামার যুদ্ধের অগ্রনায়ক বারা’আ ইবনে মালেক (রা)) Powerful Reminder - 05, Last Part

  

ঈমানদীপ্ত গল্প - ০৫

ইয়ামামার যুদ্ধের (রিদ্দার যুদ্ধ) অগ্রনায়ক বারা’আ ইবনে মালেক (রা) - ২

ঈমানদীপ্ত গল্পের আসর, গল্প - ০৫ (ইয়ামামার যুদ্ধের অগ্রনায়ক বারা’আ ইবনে মালেক (রা)) Powerful Reminder - 05, শেষাংশ


    খালিদ বিন্ ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উভয় পক্ষের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এই প্রচণ্ডতার মধ্যে চূড়ান্ত আঘাতের মাধ্যমে ইসলামের বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্যে বারাআ ইবনে মালেক আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে উদ্দেশ্য করে বলেন :

দুশমনদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়াে হে আনসার যুবক ....'।

খালিদ ইবনে ওয়ালিদের এই নির্দেশ পেয়ে বারা’আ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তার বাহিনীর যােদ্ধাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন :

‘হে আনসার ভাইয়েরা! কখনাে আপনারা মদীনায় ফিরে যাওয়ার চিন্তা করবেন না। এ মুহুর্ত হতেই আপনাদের জন্যে আর মদীনা নয়; আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাওহীদের বাণীকে চিরসমুন্নত করে জান্নাতের দিকে অগ্রসর

হােন। এই বলে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে শত্রু বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। বারা'আ ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু দক্ষতার সাথে দু’ধারী তরবারি চালিয়ে তার দু'পার্শ্বের দুশমনদের ধরাশায়ী করে সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলেন। মুসায়লামাতুল কাযযাবের যােদ্ধাদের শিরচ্ছেদ করতে করতে তিনি এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। এ আঘাতে মুসায়লামাতুল কায্যাব ও তাঁর বাহিনীর মধ্যে হঠাৎ ভীতি ও ত্রাসের সৃষ্টি হলাে। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা যুদ্ধ ময়দান সংলগ্ন বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাে। যে বাগানটি পরবর্তী সময়ে অগণিত মৃতদেহের স্কুপের কারণে ‘হাদীকাতুল মাউত’ বা ‘লাশের বাগান' নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানাবিধ ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে বাগানটি উর্দু ও প্রশস্ত দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত ছিল। যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে প্রাণ রক্ষার জন্যে মুসায়লামাতুল কায্যাব ও তাঁর অনুসারী যােদ্ধারা এ বাগানে আশ্রয় নিয়ে দ্রুত এর একমাত্র গেটটি বন্ধ করে দেয়।

এভাবে নিজেরা নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে তার ভিতর থেকে মুসলমান বাহিনীর উপর বৃষ্টির মতাে তীর বর্ষণ শুরু করে। এতে মুসলমানদের নিশ্চিত বিজয় আবার অনিশ্চয়তার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। মুসলিম যােদ্ধাদের পক্ষে তাদের মােকাবেলা করার সমস্ত পথ যেন রুদ্ধ হয়ে আসে। এ অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর অন্যতম বীর সিপাহসালার বারাআ ইবনে মালেক আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তনের মাধ্যমে শত্রুদের প্রতি এক চরম ও শেষ আঘাত হানার জন্যে পরিকল্পনা নেন। তিনি তৎক্ষণাৎ একটি ঢাল সগ্রহ করে তার বাহিনীর লােকদের উদ্দেশ্য করে বললেন :

‘আমি এ ঢালের উপরে বসে পড়ি, তােমরা আমাকে উঁচুতে উঠিয়ে ১০/১২টি বর্শা ফলকের সাহায্যে উপরে তুলে এ গেটের ভিতরে নিক্ষেপ কর। হয় আমি দুশমনদের হাতে শহীদ হয়ে যাবাে অথবা ভিতরে গিয়ে

তােমাদের জন্যে এ বাগানের গেট খুলে দেব।' দেখতে না দেখতেই বারা’আ ইবনে মালেক আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু উন্মুক্ত তরবারি হাতে তার ঢালটির উপর বসে পড়লেন। অত্যন্ত হালকা-পাতলা ও ছিপ ছিপে আনসার যুবক বারা'আকে কয়েকজনে খুব সহজেই ঢালে বসিয়ে মাথার উপর তুলে নিলেন এবং সাথে সাথে অন্য কয়েকজন বর্শাধারী তাদের বর্শা ফলকে তাকে উপরে তুলে গেটের ভিতরে মুসায়লামাতুল কাযযাবের হাজার হাজার অনুগত যােদ্ধার মাঝে সজোরে নিক্ষেপ করলেন। বারা’আ অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের মাঝে বজ্রপাতের ন্যায় লাফিয়ে পড়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্র গতিতে গেট রক্ষী বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করলেন। অন্যদিকে মুসায়লামাতুল কাযযাবের দুর্ধর্ষ সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে ভিমরুলের মতাে তাঁর উপর ঝাপিয়ে পড়ল।

তলােয়ার, বর্শা এবং তীরের উপর্যুপরি আঘাত তার গােটা দেহকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলল; কিন্তু বারা’আ ইবনে মালেক আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু তাদের গেটরক্ষী বেষ্টনির দশজনকে হত্যা করে পরিশেষে গেট খুলে দিতে সমর্থ হলেন। এদিকে সাথে সাথে অপেক্ষমাণ বীর মুসলিম যােদ্ধারা আল্লাহু আকবার' ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে বাঁধভাঙা স্রোতের মতাে ভিতরে ঢুকতে শুরু করলেন। যা ছিল এক নজীরবিহীন ভয়াল চিত্র! মুহূর্তেই উভয়পক্ষের মধ্যে পুনরায় ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুসলমানদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুসায়লামাতুল কাযযাবের বাহিনী প্রাণ ভয়ে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে লাগল আর মুসলিম যােদ্ধারা এ সুযােগে তাদেরকে দলে দলে নিঃশেষ করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত সেখানে মুসায়লামাতুল কাবের অবশিষ্ট বিশ হাজার সৈন্যের কবর রচনা করে তার দেহরক্ষী বাহিনীসহ তাকে ঘিরে ফেলে সবাইকে জাহান্নামের অতল গহবরে নিক্ষেপ করা হলাে।

সমস্ত বাগান বিশ হাজার মুরতাদের লাশের স্তুপে পরিণত হয়ে গেল। অন্যদিকে এই দুঃসাহসী বীর যােদ্ধা বারাআ ইবনে মালেক আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু, যিনি এ গেট খুলতে গিয়ে আশিটির অধিক তীর, বর্ষা ও তরবারির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন, তাঁকে বিশেষ চিকিৎসার জন্যে চিকিৎসা তাঁবুতে প্রেরণ করা হলাে। খালিদ বিন্ ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু দীর্ঘ এক মাস ধরে নিজে বারা’আ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর খিদমতে নিয়ােজিত থাকলেন। ধীরে ধীরে বারা'আ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সুস্থ হয়ে উঠলেন। তাঁর এই মহান ত্যাগ, এবং কুরবানীর বদৌলতে আল্লাহ রাব্দুল আলামীন তাঁরই হাতে মুসলমানদের এ যুদ্ধে বিজয় দান করে জাযীরাতুল আরবকে চিরদিনের জন্যে ভণ্ডনবী ও মুরতাদদের হাত থেকে পবিত্র করলেন।


তথ্যসূত্র: সাহাবীদের আলোকিত জীবন (ড. আব্দুর রহমান রাফাত পাশা)





Post a Comment

0 Comments