ঈমানদীপ্ত গল্পের আসর, গল্প - ০৫ (ইয়ামামার যুদ্ধের অগ্রনায়ক বারা’আ ইবনে মালেক (রা)) Powerful Reminder - 05, প্রথমাংশ

ঈমানদীপ্ত গল্প - ০৫

ইয়ামামার যুদ্ধের (রিদ্দার যুদ্ধ) অগ্রনায়ক বারা’আ ইবনে মালেক (রা) - ১

ঈমানদীপ্ত গল্পের আসর, গল্প - ০৫ (ইয়ামামার যুদ্ধের অগ্রনায়ক বারা’আ ইবনে মালেক (রা)) Powerful Reminder - 05

    বারা’আ ইবনে মালেক আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ইতিহাস সৃষ্টিকারী অসংখ্য ঘটনাবলির মধ্যে একটিমাত্র ঘটনা প্রিয় পাঠকদের খিদমতে পেশ করা হচ্ছে : বারা’আ ইবনে মালেক আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর সাহসিকতার পরিচয় ফুটে উঠে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর যখন নবদীক্ষিত মুসলমানরা যেভাবে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেভাবেই না বুঝে দলে দলে ভণ্ডনবীদের দলে শামিল হচ্ছিল।

ইসলামের এই চরম দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে আল্লাহ যাদের দৃঢ় মনােবল এবং ঈমানী মযবুতি দান করেছিলেন, শুধু তারা ব্যতীত অন্য সকলেই মুরতাদদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তায়েফ, মক্কা ও মদীনাসহ এর পার্শ্ববর্তী বিক্ষিপ্ত কিছু গােত্র ছাড়া বাকি সর্বত্রই এই ফিতনা ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। 

এই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে আল্লাহ রাব্বল আলামীন ইসলামের হেফাযতের জন্যে আমীরুল মুমিনীন আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে চতুর্মুখী ফিতনা মােকাবেলার যােগ্যতা ও দৃঢ়তা দান করেন। তিনি পাহাড়সম অটল হয়ে একাধারে যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীদের এবং ভণ্ড নবী ও তাদের অনুসারী মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘােষণা করলেন। আনসার এবং মুহাজিরদের সমন্বয়ে তিনি সশস্ত্র এগারােটি বিশেষ বাহিনী তৈরী করে প্রত্যেক বাহিনীর জন্যে আলাদা আলাদা ঝাণ্ডা নির্ধারণ করলেন। ভণ্ড নবীদের সমুচিত শিক্ষা দিয়ে বিপথগামী ও ধর্মত্যাগী মুরতাদদের ইসলামে প্রত্যাবর্তনের জন্যে এসব বাহিনীকে আরব বিশ্বের চতুর্দিকে প্রেরণ করেন। | 

ভণ্ড নবী ও তাদের অনুসারী মুরতাদদের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিল বনূ হানীফা সম্প্রদায়ের মুসায়লামাতুল কাযযাবের। মুসায়লামাতুল কাম্ব তার নিজস্ব গােত্র এবং সন্ধিতে আবদ্ধ সম্প্রদায়সমূহের সুদক্ষ চল্লিশ হাজার যােদ্ধার এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছিল। এই বাহিনী ইসলামের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যাদের অধিকাংশই ছিল সংকীর্ণ ভৌগােলিক ও বংশীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। যারা ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবােধের পরিবর্তে গােত্রীয় গোঁড়ামি, সংকীর্ণতা ও আঞ্চলিকতার শিকারে পরিণত হয়েছিল। তাদের মতে, অনেকের ভাষ্য ছিল :

‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিঃসন্দেহে মুসায়লামাতুল কাযব একজন ভণ্ড নবী এবং মুহাম্মদ সত্য নবী; কিন্তু আমাদের কাছে কুরাইশ বংশের সত্য নবীর চেয়ে স্বগােত্রীয় ভণ্ডনবী ও মিথ্যাবাদী মুসায়লামাতুল কাযযাবই ভালাে।' 

আমীরুল মু'মিনীন আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মুসায়লামাতুল কাবের মােকাবেলা করার জন্যে আবূ জাহলের ছেলে ইকরামা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নেতৃত্বে যে বাহিনী পাঠিয়েছিলেন, প্রচণ্ড হামলার মুখে তারা পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। অতঃপর আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু খালিদ বিন্ ওয়ালিদের নেতৃত্বে আনসার এবং মুহাজির সাহাবাদের মধ্যে বিশিষ্ট যােদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত যে বাহিনী প্রেরণ করেন, তাদের মধ্যে বারা'আ ইবনে মালেক আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুও ছিলেন।

খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ভণ্ডনবী মুসায়লামাতুল কাযযাব। এবং তার অনুসারীদের সমুচিত শিক্ষা দিয়ে পুনরায় ইসলামে দীক্ষিত করার জন্যে সাহাবী যােদ্ধাদের নেতৃত্বে এই বিশেষ বাহিনী নিয়ে দ্রুতগতিতে নাজদের ইয়ামামা' নামক প্রান্তরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। মুহূর্তের মধ্যেই উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হলাে। যুদ্ধ শুরুর প্রায় সাথে সাথেই মুসায়লামাতুল কাবের বিশাল বাহিনী মুসলিম বাহিনীকে কাবু করে ফেলে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, সুশৃঙ্খল মুসলিম বাহিনীর পায়ের নিচের মাটি যেন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল। নিজেদের অবস্থান থেকে ক্রমেই তারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। 

এই নাজুক মুহূর্তে মুসায়লামাতুল কায্যাবের বাহিনী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি খালিদ বিন্ ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর তাঁবুতে হামলা করে তাঁবুর খুঁটি উপড়ে ফেলে। এমনকি সেখানে অবস্থানরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর স্ত্রীকে হত্যার জন্যে উদ্যত হলে মুসায়লামাতুল কাযযাব বাহিনীরই একজন যােদ্ধা জাহিলিয়াতের প্রথানুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে শিশু ও নারীদের হত্যা করা কাপুরুষােচিত ও গর্হিত কাজ’- এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে নিরাপত্তা দিয়ে রক্ষা করে। এ চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় মুসলিম যােদ্ধারা নিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। 

তাঁরা এ কথা মনে করছিলেন যে, মুসায়লামাতুল কায়যাবের কাছে আজ পরাজয়ের পর এই আরব বিশ্বে ইসলামের নাম উচ্চারণ করার মতাে আর কোনাে ব্যক্তি অবশিষ্ট থাকবে না। শিরকমুক্ত এই জাযীরাতুল আরবে তাওহীদের বাণী উচ্চারণ ও আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আর কেউ সাহস করবে না। সেনাপতি খালিদ বিন্ ওয়ালিদের নিজের ভাবু আক্রান্ত হওয়ার পর এই চরম নাজুক মুহূর্তে খালিদ বিন্ ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বিক্ষিপ্ত মুসলিম বাহিনীকে তৎক্ষণাৎ পুনর্গঠিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সাথে সাথে তিনি মুহাজির, আনসার, শহরবাসী ও মরুবাসী বেদুইন যােদ্ধাদের ভিন্ন ভিন্ন রেজিমেন্টে বিভক্ত করে প্রত্যেক রেজিমেন্টের জন্যে স্বগােত্রীয় উপ-সেনাপতি ও ভিন্ন ভিন্ন ঝাণ্ডা নির্ধারণ করেন। যেন প্রত্যেক বাহিনী স্বীয় অস্তিত্বের স্বার্থেই শত্রু বাহিনীর মােকাবেলায় মরণপণ চেষ্টা চালায় এবং কোন্ সেক্টর থেকে দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাও চিহ্নিত করা সহজ হয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই উভয় বাহিনীর মাঝে পুনরায় প্রচণ্ড যুদ্ধ বেধে গেল। ভয়াবহ সে যুদ্ধ! মুসলিম যােদ্ধারা এর পূর্বে এমন মারাত্মক কোনাে সংঘর্ষ কখনও প্রত্যক্ষ করেননি। এবার বীর বিক্রমে মুসলিম বাহিনী শত্রুবাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল। তারা মুসায়লামাতুল কাযযাব বাহিনীর যােদ্ধাদের ধরাশায়ী করে ইয়ামামার ময়দান লাশের স্কুপে পরিণত করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অপরপক্ষে, মুসায়লামাতুল কাযযাবের বাহিনী তাদের এই মারাত্মক ক্ষয়-ক্ষতি প্রত্যক্ষ করেও যুদ্ধ ময়দানে তখনও পাহাড়ের মতাে অটল হয়ে মুসলমানদের মােকাবেলা অব্যাহত রাখল।

মুসলিম যােদ্ধারা ঈমানী চেতনায় বলীয়ান হয়ে যুদ্ধের ক্ষিপ্রতাকে আরও তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছিল। ছাবিত বিন্ কায়েস রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মুসলিম যােদ্ধাদের মধ্যে আনসার বাহিনীর ঝাণ্ডাবরদার (পতাকাবাহক) ছিলেন। তিনি যুদ্ধের এই তীব্রতা লক্ষ্য করে তার পরিচালিত বাহিনীর এই ঝাণ্ডাকে পিছনে সরিয়ে নিতে হতে পারে, তা আঁচ করে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধ ময়দানে তার দুপায়ের হাঁটু পর্যন্ত মাটির নিচে গেড়ে ফেললেন।

মুহূর্তেই শত্রু সৈন্যরা তার বহনকৃত ঝাণ্ডাকে ভুলুণ্ঠিত করার জন্যে তার ওপর আঘাত হানতে শুরু করল। তিনি একহাতে ঝাণ্ডাকে সমুন্নত রেখে অন্যহাতে তরবারি চালনা করে এ আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে এক পর্যায়ে দুশমনের তরবারির আঘাতে দ্বিখণ্ডিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। যুদ্ধের এই তীব্রতা ও প্রচণ্ডতার মাঝে মুহাজির বাহিনীর মধ্য হতে আমিরুল মু'মিনীন উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর ভাই যায়েদ ইবনুল খাত্তাব দুশমনের উপর আরও তীব্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে মােহাজিরদের উদ্দেশ্যে চিল্কার করে বলছিলেন :

... “হে মুসলিম যােদ্ধারা! আরও ক্ষীপ্র গতিতে আঘাত হানাে, সম্মুখপানে অগ্রসর হও, শক্রদের উপর ঝাপিয়ে পড়াে, হে যােদ্ধারা জেনে রাখাে, এটাই তােমাদের প্রতি আমার শেষ আহ্বান। হয় আজ মুসায়লামাতুল কাযযাবকে নিশ্চিহ্ন করবাে অথবা শহীদ হয়ে আল্লাহর দরবারে পৌছে নিজের অপারগতা পেশ করবাে।'

এ আহ্বানের সাথে সাথেই সমস্ত মুসলিম মুজাহিদ নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শত্রুবাহিনীর উপর প্রচণ্ড আঘাত হানতে শুরু করল। যায়েদ বিন্ খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু দু'হাতে তরবারি চালাতে চালাতে ক্ষীপ্রগতিতে দুশমনদের মাঝে ঢুকে পড়লেন। অসংখ্য মুরতাদদের ধরাশায়ী করার এক পর্যায়ে শত্রুর আঘাতে তিনি শাহাদাতের কোলে ঢলে পড়ে তার কৃত ওয়াদাকে বাস্তবে প্রমাণিত করেন। আবূ হুযায়ফার কৃতদাস সালেম রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর উপর মুহাজির বাহিনীর ঝাণ্ডা বহন করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। মুহাজিরদের অনেকেই তার প্রতি আশঙ্কা পােষণ করছিলেন যে, যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে তিনি সন্ত্রস্তবােধ করবেন। তারা তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন :

‘আমরা আশঙ্কা করছি যে, তুমি যুদ্ধের প্রচণ্ডতায় ভীত হয়ে পশ্চাদপসরণ না করে বসাে।' এবং এই সুযােগে শত্রুবাহিনী আমাদের ভিতরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা না করুক। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন :

‘আমি যদি এ যুদ্ধে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করি তাহলে আমার চেয়ে নিকৃষ্টতম হাফেযে কুরআন আর কে হতে পারে? অতঃপর তিনি বীর বিক্রমে দুশমনদের প্রতি আঘাত হানতে হানতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। মুরতাদদের তরবারির আঘাতের পর আঘাতে তার গােটা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়; কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি ইসলামের ঝাণ্ডাকে এক মুহূর্তের জন্যে ভূলুষ্ঠিত হতে দেননি। কিন্তু এ যুদ্ধে বারা’আ ইবনে মালেক আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর বীরত্বের কাছে এসব ঘটনা একেবারে নগণ্য বলে মনে হবে।


শেষ পর্ব







Post a Comment

0 Comments