ঈমানদীপ্ত গল্পের আসর, গল্প - ০৭: হত্যার পরিকল্পনায় মসজিদে নববীতে উমায়ের (রা)

ঈমানদীপ্ত গল্প - ০৭

প্রতিজ্ঞা যখন বদরের প্রতিশোধ

ঈমানদীপ্ত গল্পের আসর, গল্প - ০৭: হত্যার পরিকল্পনায় মসজিদে নববীতে উমায়ের (রা), ঈমানদীপ্ত গল্প, সাহাবীদের জীবনী, ইসলামী গল্প, ইসলামের ইতিহাস,


    উমায়ের ইবনে ওয়াহাব রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর একই জীবনের মধ্যে ছিল দু'টি ধারা। একটি ছিল ইসলাম গ্রহণের পূর্ব-জীবন আর অন্যটি ছিল ইসলাম গ্রহণের পরের জীবন। তার ইসলাম গ্রহণের পূর্ব-জীবন ছিল অত্যন্ত রােমাঞ্চকর। বদর যুদ্ধে সে ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল; কিন্তু তার তরবারি তাকে মােটেই সাহায্য করতে পারেনি; বরং সে এক পর্যায়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখােমুখি হয়েছিল। 


আল্লাহ তাআলা তাকে ইসলামের জন্যে কবুল করে নিয়েছিলেন বলে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে সে রক্ষা পায়। এ জন্যে সে মক্কায় ফিরে আসতে সমর্থ হয়; কিন্তু তার ছেলে ওয়াহাব মুসলমানদের হাতে বন্দী অবস্থায় মদীনায়ই রয়ে যায়। উমায়ের ইবনে ওয়াহাব আশঙ্কা করেছিল যে, মক্কায় মুহাম্মদের উপর যেমন নির্যাতনের স্টীম রােলার চালানাে হয়েছিল, তার ছেলেকে আটকাবস্থায় নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তার কৃত অপরাধের প্রতিশােধ নেবে মুসলমানরা। এ দুশ্চিন্তায় উমায়ের ইবনে ওয়াহাব অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়ে।


কোনাে এক দুপুরে ছেলের মুক্তির জন্যে প্রার্থনা করার উদ্দেশ্যে সে দেবতাদের জন্যে কিছু ভােগসামগ্রী নিয়ে কাবাগৃহে হাজির হয়। এ সময়ে কুরাইশ সরদার সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বাইতুল্লাহর সন্নিকটস্থ হাজের নামক স্থানে উপবিষ্ট ছিল, তার সঙ্গে উমায়েরের সাক্ষাৎ ঘটে। তারা পরস্পরে কুশলবিনিময় করে। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া তখন উমায়ের ইবনে ওয়াহাবকে বলল :


বসাে ভাই! কিছু সুখ-দুঃখের কথা বলি, সময় আর কাটছে না। আমাদের কলিজার টুকরাদের মদীনায় বন্দী রেখে মােটেও শান্তিতে ঘুমাতে পারছি না।'


অতঃপর তারা একে অপরের মুখােমুখি বসে বদর যুদ্ধের বিভিন্ন বিভীষিকাময় ঘটনার আলােচনা শুরু করে। আলাপচারিতায় তারা কখনাে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীদের হাতে যুদ্ধবন্দী কুরাইশদের সংখ্যা নির্ণয় করছিল, আবার কখনাে মুসলমানদের তরবারির আঘাতে তাদের নিহত নেতৃবৃন্দের কথা স্মরণ করে ভয়ে শিউরে উঠছিল। যাদের লাশ দিয়ে বদরের পুরানাে ডােবাগুলাে ভরাট করা হয়েছিল। আলােচনার এক পর্যায়ে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলল :


‘আজ আমাদের নেতারা মুসলমানদের হাতে নিহত, যুবকরা তাদের হাতে বন্দী। আল্লাহর কসম! আমাদের বেঁচে থাকার আর কি কোনাে সার্থকতা আছে?” 


এ কথা শুনে উমায়ের তার কথায় সায় দিয়ে বলল : ‘তুমি যথার্থই বলেছ। সত্যিই, আমাদের বেঁচে থাকার আর কোনাে যৌক্তিকতা নেই। এরপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে পুনরায় সে বলল :


‘এই কাবার মালিকের কসম! আমি যদি ঋণগ্রস্ত না হতাম অথবা আজ আমার ঋণ পরিশােধ করার মতাে কোনাে ব্যবস্থা থাকত অথবা আমার অনুপস্থিতিতে সন্তান-সন্ততির অনাহারে মৃত্যুবরণ করার আশঙ্কা না করতাম তাহলে নিশ্চয়ই আমি মদীনায় গিয়ে মুহাম্মদকে এ দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় করে দিতাম এবং তাঁর মিশনকে স্তব্ধ করে দিয়ে আরববাসীকে এ অত্যাচার হতে মুক্ত করতাম।'


এরপর সে মৃদুস্বরে বলল : ‘আমি যদি মদীনায় মুহাম্মদকে হত্যা করতে যাই, তাহলে কেউ আমাকে সন্দেহ করবে না যে, আমি তাঁকে হত্যা করতে এসেছি; বরং সবাই ভাববে যে, আমি আমার বন্দী ছেলের মুক্তির জন্যে তদবির করতে এসেছি।' সাফওয়ান কালবিলম্ব না করে উমায়েরের ভাবাবেগকে লুফে নিয়ে বলল :


‘হে উমায়ের! তােমার সমস্ত ঋণের বােঝা আমার উপর ছেড়ে দাও। পাহাড়সম ঋণকেও আমি পরিশােধ করতে প্রস্তুত। আর তােমার সমস্ত পরিবার-পরিজনকে আজই আমি আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করে নিচ্ছি। যতদিন আমি বেঁচে থাকবাে ততদিন আমার অর্থ ও ধন-সম্পদের প্রাচুর্য তােমার পরিবারের জন্যে ব্যয়িত হবে। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া’র এই তেজোদ্দীপ্ত প্রতিশ্রুতি শুনে উমায়েরের মধ্যকার হিংস্র পশুশক্তি গর্জন করে উঠল। সে সাফওয়ানকে বলল :


তাহলে আমাদের দু'জনের মধ্যকার এ চুক্তির কথা আর করাে কাছে প্রকাশ করাে না। আমি আমার কর্তব্য সম্পাদনের জন্যে বদ্ধপরিকর। রাসূলুল্লাহ (স)-এর প্রতি উমায়েরের হৃদয়ে হিংসার যে আগুন জ্বলছিল, সাফওয়ানের উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রতিশ্রুতি তা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। 


সে অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাবাঘর থেকে বাড়ি ফিরল এবং পরিকল্পনাকে সামনে নিয়ে প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করল। যেহেতু কুরাইশদের প্রায় প্রতিটি ঘরের কোনাে না কোনাে লােক মুসলমানদের হাতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে মদীনায় ছিল, সেহেতু কয়েদিদের আত্মীয়-স্বজন সব সময়ই তাদের মুক্ত করার ব্যাপারে মদীনায় আসা-যাওয়া করত। তাই উমায়েরের মদীনা যাওয়াকে মুসলমানেরা কেউই সন্দেহের চোখে দেখবে না বলেই তার বিশ্বাস ছিল। 


উমায়ের ইবনে ওয়াহাব পূর্ণ মানসিক প্রস্তুতি সহকারে মদীনা রওয়ানা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল এবং স্বীয় তরবারি আরও শাণিত করে তাতে বিষ মেখে নিলাে। অবশেষে সফর সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেল। তাকে বহনকারী উট যতই মদীনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, উমায়েরের হিংসার আগুন ততই দাউ দাউ করে জ্বলছিল। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এক পর্যায়ে উটটি মদীনায় মসজিদে নববীর কাছে এসে পৌছল। উমায়ের সেখানে অবতরণ করে তার বিষাক্ত তরবারি নিয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খোঁজার জন্যে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করল। 


এদিকে উমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু মসজিদে নববীর দরজার নিকট বসে কিছুসংখ্যক সাহাবীর সাথে বদরের যুদ্ধবন্দী ও মৃত কুরাইশদের নেতৃত্বের পরাজয়ের ঘটনাবলি, মুসলমানদের সাহসিকতা ও বীরত্বের বর্ণনা এবং আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির আলােচনা করছিলেন। হঠাৎ মুখ ফেরাতেই তিনি দেখতে পেলেন যে, অস্ত্রসজ্জিত উমায়ের ইবনে ওয়াহাব মসজিদে নববীতে প্রবেশ করছে। তিনি চমকে উঠলেন এবং তার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে চিৎকার করে বলে উঠলেন :


‘আল্লাহর দুশমন, উমায়ের ইবনে ওয়াহাব। নিশ্চয়ই কোনাে খারাপ মতলব নিয়ে এ মসজিদে প্রবেশ করছে। এই সেই ব্যক্তি, যে মক্কায় আমাদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের লেলিয়ে দিয়েছিল এবং বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে ভীষণ ব্যস্ত ছিল। সে কোনাে মহৎ উদ্দেশ্যে এখানে আসতে পারে না।' এই বলে তিনি উপস্থিত সাহাবীদের তৎক্ষণাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চারদিকে অবস্থান গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেন এবং ঐ ব্যক্তির নাশকতামূলক কাজ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকার জন্যে বললেন। 


অতঃপর উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে বললেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দুশমন উমায়ের ইবনে ওয়াহাব অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করেছে। নিশ্চয়ই তার কোনাে কুমতলব রয়েছে। এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :


তাকে আমার কাছে নিয়ে এসাে। উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু এ আদেশ শােনার পর উমায়েরের কাছে ফিরে গিয়ে এক হাতে উমায়েরের তরবারি এবং অন্য হাতে তার জামার কলার ধরে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে এলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দৃশ্য দেখে উমায়েরকে ছেড়ে দিয়ে উমর ফারূক রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন।


অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমায়ের ইবনে ওয়াহাবকে নিকটে ডাকলেন। উমায়ের এসে জাহিলী নিয়মে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম জানাল। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন :


‘শােনাে উমায়ের, আল্লাহ আমাকে তােমাদের সালামের চেয়ে আরও উত্তম সালাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন। এ সালাম হলাে বেহেশতের সালাম,


আস্সালামু আলাইকুম। উমায়ের বলল :


কই, খুব বেশি পার্থক্য তাে মনে হচ্ছে না; কিছুদিন আগেও তাে এটাই ছিল আপনার সালাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন :


উমায়ের! কী উদ্দেশ্যে তুমি এখানে এসেছ? উমায়ের বলল :


যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করার জন্যে এসেছি। আশা করি, এ ব্যাপারে আপনি আমাকে সার্বিক সহযােগিতা দান করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :


বন্দীমুক্তির উদ্দেশ্যেই যদি এসে থাকে, তাহলে অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় কেন?” 


উমায়ের বলল :


‘আল্লাহ এ তলােয়ারকে ধ্বংস করুন! বদরে এ তলােয়ার কি আমাদের কোনাে কাজে এসেছে?” রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন :


‘উমায়ের! সত্যি করে বলাে, কী উদ্দেশ্যে তুমি এসেছ? উমায়ের বলল ; ‘বিশ্বাস করুন, দ্বিতীয় কোনাে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এখানে আসিনি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : ‘উমায়ের! তুমি এবং সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া খানায়ে কাবার হাজের নামক স্থানে বসে বদর যুদ্ধের পরাজয় সম্পর্কে কি কখনাে আলােচনা করছিলে? তখন কি তুমি বলনি যে, ‘আমি যদি ঋণগ্রস্ত না হতাম, অথবা সন্তান-সন্ততি আমার উপর নির্ভরশীল হতাে, তাহলে আমি মুহাম্মদকে হত্যার উদ্দেশ্যে অবশ্যই মদীনায় রওয়ানা হতাম।' তােমার এ কথার পবিপ্রেক্ষিতে সাফওয়ান ইবনে উমায়ের আমার হত্যার বিনিময়ে তােমার ঋণ এবং সন্তান-সন্ততির সব দায়-দায়িত্ব কি গ্রহণ করেনি? তােমরা দু'জন হয়তাে মনে করেছিলে যে, তােমরা ব্যতীত এ কথাগুলাে আর কেউ শােনেনি। অথচ তােমাদের উভয়ের মাঝে আল্লাহ বিদ্যমান ছিলেন।' রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ থেকে এ কথা শুনে উমায়ের হতভম্ব হয়ে গেল এবং নির্বিকারে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল :


‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আল্লাহর পক্ষ হতে যে পয়গাম নিয়ে এসেছেন, আমরা তাকে


মিথ্যা সাব্যস্ত করতাম; কিন্তু আমার এবং সাফওয়ানের মাঝে যে কথােপকথন হয়েছিল, তা আমরা দু'জন ব্যতীত আর কেউই জানত না। আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করেছেন। আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি কোনাে না কোনােভাবে আমাকে আপনার কাছে এনে ইসলামের আলাে দিয়ে আলােকিত করেছেন। আমি এখন আর আপনার দুশমন উমায়ের ইবনে ওয়াহাব নই; বরং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, “আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনাে ইলাহ নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,আপনি আল্লাহর বান্দাহ ও তাঁর প্রেরিত রাসূল। এ ঘােষণার মাধ্যমেই উমায়ের ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন। তৎক্ষণাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের এই বলে নির্দেশ দিলেন :


فقهوا أخام في دينه ، وعلموه القران ، وأطلقوا أسيره".


“তােমাদের এই ভাইকে দীন সম্পর্কে জ্ঞান দাও, তাকে কুরআন শিক্ষা দাও


এবং তার বন্দীদের মুক্ত করে দাও। উমায়েরের ইসলাম গ্রহণের সংবাদে মদীনার মুসলমানদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।


আরও পড়ুন......




Post a Comment

0 Comments