বিশ্বস্ততার পরীক্ষা (একটি ঈমানদীপ্ত গল্প) ঈমানদীপ্ত গল্প -০১

ঈমানদীপ্ত গল্প -০১

 বিশ্বস্ততার পরীক্ষা



একদিন মদীনার দুই ব্যক্তি একজন যুবককে টেনে হিছড়ে, অর্ধ পৃথিবীর শাসক,খলীফা, হযরত উমর (রাঃ) এর দরবারে হাজির করলেন এবং অভিযোগ দাখিল করে বিচার চাইলেন যে, এই যুবক আমাদের পিতাকে হত্যা করেছে। আমরা এর ন্যায় বিচার চাই।

তখন খলীফা  হযরত উমর (রাঃ) সেই যুবককে প্রশ্ন করলেন, তার বিরুদ্ধে করা  অভিযোগ সঠিক কিনা? তখন সেই যুবক বললেন,তাদের অভিযোগ সম্পুর্ণ সত্য এবং বিষয়টি বর্ণনা করলেন,

"আমি ক্লান্তির কারনে বিশ্রামের জন্য এক খেজুর গাছের ছায়ায় বসলাম। ক্লান্ত শরীরে অল্পতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার একমাত্র পছন্দের বাহন আমার উটটি পাশে নেই।

খুঁজতে খুঁজতে কিছু দূর গিয়ে উটটিকে মৃত দেখতে পেলাম। পাশেই ওদের বাবা ছিলো। তিনিই আমার উটটিকে তাদের বাগানে প্রবেশের অপরাধে পাথর মেরে হত্যা করেছেন।

আমিও রাগান্বিত হয়ে তাদের বাবার সাথে তর্কাতর্কি করতে করতে এক পর্যায়ে তাদের বাবার মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে ফেলি, ফলে সে সেখানেই মারা যায়। যা সম্পুর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হয়ে গেছে। যার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।" 

বাদী'রা বললেন:- আমরা এর মৃত্যুদণ্ড চাই। হযরত উমর (রাঃ) বিস্তারিত শুনে বললেন উট হত্যার বদলে একটা উট নিলেই হতো। কিন্তু তুমি বৃদ্ধকে হত্যা করেছো। হত্যার বদলে হত্যা। এখন তোমাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। তোমার কোন শেষ ইচ্ছা থাকলে বলতে পারো।

নওজোয়ান বললেন, আমার কাছে কিছু ঋন ও অন্যের কিছু আমানত আছে। আমাকে যদি কিছুদিন সময় দিতেন তবে আমি বাড়ি গিয়ে আমানত ও ঋন গুলি পরিশোধ করে আসতাম। খলিফা হযরত উমর (রাঃ) বললেন তোমাকে একা ছেড়ে দিতে পারি না। যদি তোমার পক্ষ থেকে কাউকেও জিম্মাদার রেখে যেতে পারো তবে তোমায় সাময়িক মুক্তি দিতে পারি।

নিরাশ হয়ে নওজোয়ান বললো, এখানে আমার কেউ নেই। যে আমার জিম্মাদার হবে। একথা শুনে হঠাৎ মজলিসে উপস্থিত, আল্লাহর নবীর এক সাহাবী হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, আমি হবো ওর জামিনদার। সাহাবী হযরত আবু যর গিফারীর (রাঃ) এই উত্তরে সবাই হতবাক। একেতো অপরিচিত ব্যক্তি তার উপর হত্যার দন্ড প্রাপ্ত আসামীর জামিনদার!

খলিফা বললেন আগামি শুক্রবার জুম্মা পর্যন্ত নওজোয়ানকে মুক্তি দেওয়া হলো। জুম্মার আগে নওজোয়ান মদিনায় না আসলে নওজোয়ানের বদলে আবুজর গিফারীকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে।

মুক্তি পেয়ে নওজোয়ান ছুটলো মাইলের পর মাইল দূরে তার বাড়ির দিকে। আবুজর গিফারী (রাঃ) চলে গেলেন তাঁর বাড়িতে। এদিকে দেখতে দেখতে জুম্মাবার এসে গেছে, নওজোয়ানের কোন খবর নেই।

হযরত উমর (রাঃ) রাষ্ট্রীয় পত্রবাহক পাঠিয়ে দিলেন আবুজর গিফারি (রাঃ) এর কাছে। পত্রে লিখা আজ শুক্রবার বাদ জুমা সেই যুবক যদি না আসে আইন মোতাবেক আবু যর গিফারির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে। আবুজর গিফারি যেন সময় মত জুমার প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে নববীতে হাজির হয়।

খবর শোনে সারা মদীনায় থমথমে অবস্থা। একজন নিষ্পাপ সাহাবী আবুজর গিফারী আজ বিনা দোষে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হবে।

জুমার পর মদিনার সবাই মসজিদে নববীর সামনে হাজির। সবার চোখে পানি। জল্লাদ প্রস্তুত। জীবনে কতজনের মৃত্যুদন্ড দিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। কিন্তু আজ কিছুতেই জল্লাদের চোখের পানি আটকাতে পারছে না। আবুজরের মত একজন সাহাবী সম্পূর্ন বিনা দোষে আজ মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হবে, এটা মদীনার কেহুই মেনে নিতে পারছেন না। এমনকি মৃত্যুদন্ডের আদেশ প্রদানকারী খলিফা উমর (রাঃ)ও অনবরত কাঁদছেন।  তবুও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারো পরিবর্তনের হাত নেই। আবু জর (রাঃ) তখন ও নিশ্চিন্ত মনে হাসি মুখে দাড়িয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। জল্লাদ ধীর পায়ে আবুজর গিফারী (রাঃ) এর দিকে এগুচ্ছেন আর কাঁদছেন। আজ যেন জল্লাদের পা চলে না। এক পা আগায় তো তিন পা পিছায়। পায়ে যেন কেউ পাথর বেঁধে রেখেছে।

এমন সময় এক সাহাবী জল্লাদকে বললো, হে জল্লাদ একটু থামো। মরুভুমির ধুলার ঝড় উঠিয়ে ঐ দেখো কে যেন আসতেছে। হতে পারে ঐটা নওজোয়ানের ঘোড়ার ধুলি। একটু দেখে নাও, তারপর না হয় আবু জরের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করিও। ঘোড়াটি কাছে আসলে দেখা যায় সত্যিই এটা ঐ নওজোয়ান।  

নওজোয়ান দ্রুত খলিফার সামনে এসে বললো, হুযুর বেয়াদবি মাফ করবেন। রাস্তায় যদি ঘোড়ার পা'য়ে ব্যাথা না পেতো,তবে সঠিক সময়েই আসতে পারতাম। বাড়িতে আমি একটুও দেরী করি নাই। বাড়ি পৌছে গচ্ছিত আমানত ও ঋন পরিশোধ করি এবং তারপর বাড়ী এসে বাবা, মা এবং নববধুর কাছে সব খুলে বলে চিরবিদায় নিয়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। এখন আবু যর (রাঃ) ভাইকে ছেড়ে দিন। আমাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে পবিত্র করুন। কেয়ামতে খুনি হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই না। আশেপাশে সবাইর মাঝে নীরব থমথমে অবস্থা। সবাই হতবাক, কি হতে চলেছে?

যুবকের পুনরায় ফিরে আসাটা অবাক করে দিলো সবাইকে। খলিফা হযরত উমর (রাঃ) বললেন, তুমি জানো তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে, তারপরে ও কেন ফিরে এলে? উত্তরে সেই যুবক বলেন:- আমি ফিরে এসেছি, কেউ যাতে বলতে না পারে, এক মুসলমানের বিপদে আরেক মুসলমান সাহায্য করতে এগিয়ে এসে নিজেই বিপদে পড়ে গিয়েছেন।

এবার হযরত উমর (রাঃ) হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কেন না চেনা সত্যেও এমন এক লোকের জামিনদার হলেন?

উত্তরে হযরত আবুজর গিফারী (রাঃ) বললেন, পরবর্তিতে কেউ যেন বলতে না পারে, এক মুসলমান বিপদে পড়েছিলো, অথচ কেউ তাকে সাহায্য করতে আসেনি। এমন কথা শুনে, হঠাৎ, বৃদ্ধার দুই সন্তানের মাঝে একজন বলে উঠলেন, হে আমিরুল মোমেনীন খলীফা, আপনি তাকে মুক্ত করে দিন। আমরা তার উপর করা দাবী তুলে নিলাম।

হযরত উমর (রাঃ) বললেন, কেন.?

তাদের মাঝে একজন বলে উঠলেন, কেউ যেন বলতে না পারে,এক মুসলমান অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল করে নিজেই ভুল শিকার করে ক্ষমা চাওয়ার পরেও অন্য মুসলমান তাকে ক্ষমা করেনি। খলীফা হযরত ওমর (রাঃ) তাকে ক্ষমা করতঃ মুক্ত করে দিলেন।

#সুবহানাল্লাহ 

( হায়াতুস সাহাবা:-৮৪৪) 






Post a Comment

0 Comments